আওয়ামিলীগ এর পতন এর জন্য আওয়ামিলীগ এর দায় কতটা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য আওয়ামিলীগ এর প্রয়োজনীয়তা

 ইতিহাসে অনেক রাজনৈতিক দল স্বাধীনতা লাভের মতো ঐতিহাসিক অবদানও রেখেছে। কিন্তু এমন রাজনৈতিক দলও খুব বেশি দিন মানুষের সমর্থন নিয়ে টিকে থাকতে পারেনি। মূল দল ভেঙে একাধিক রাজনৈতিক দল, শাখা-প্রশাখা হয়েছে। আমাদের এই অঞ্চলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভে দুটি রাজনৈতিক দল বেশ জনসমর্থন লাভ করে। এক কথায় দুটি দল ভারতবর্ষে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা লাভে জাতীয় কংগ্রেস এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় মুসলিম লীগ নেতৃত্ব দেয়।


ইতিহাসের অভিজ্ঞতা হলো- মুসলিম লীগ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববাংলায় অতিদ্রুত জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে দলটির যে পরাজয় ঘটে তা আর কেটে ওঠা সম্ভব হয়নি। যদিও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার মুসলিম লীগ এবং মুসলিম লীগের নব-সংস্করণে গঠিত দল নিয়ে সামরিক শাসকরাও রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু পূর্ববাংলার জনগণের মন থেকে মুসলিম লীগ ১৯৪৭-৪৮ সালেই উঠে যেতে থাকে এবং দলটি এই অঞ্চলে আর কোনোদিন দাঁড়াতে পারেনি।

পশ্চিম পাকিস্তানে এখনও বিভিন্ন ব্র্যাকেটবন্দি নামে থাকলেও মুসলিম লীগের গুরুত্ব পাকিস্তানে অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। ভারতে জাতীয় কংগ্রেস এখনও টিকে থাকলেও গত প্রায় ২৫ বছর ধরে জাতীয় কংগ্রেসের অবস্থান অনেকটাই দুর্বল হতে দেখা যাচ্ছে। এসব অভিজ্ঞতা বিবেচনা করলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা বেশ ভিন্ন।


যদিও এ দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবোদ্ধা ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্ত মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড এবং ১৯৯১-এর নির্বাচনে পরাজয়ের পর বেশ সদম্ভে উচ্চারণ করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ নিশ্চিতভাবেই মুসলিম লীগের ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ১৯৭৫-এর পর থেকে দাবি করে আসছিল যে, আওয়ামী লীগ আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না, ক্ষমতায় আসতে দেয়াও হবে না। এই চেষ্টা ২১ আগস্ট তারিখে কিংবা এর আগে এবং পরে অনেকবারই করা হয়েছে, এখনও করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছে, দেশ শাসন করছে, দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও পরিবর্তনে বড় ধরনের ভূমিকাও রাখছে।


এই দল পাকিস্তানকালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম জোরদার করেছে, ছয় দফার আন্দোলনকে এক দফায় রূপান্তরিত করে স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বাধীনতার পর দলটি একটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার শাসনতন্ত্র, অবকাঠামোগত ভিত্তি, জাতি গঠনের প্রয়োজনীয়তা থেকে শিক্ষায় আমূল পরিবর্তনসহ মৌলিক কর্মসূচি প্রদানের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছিল।


দলের প্রধান, নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগীদের হত্যা, আওয়ামী লীগকে ভেঙে তছনছ করে দেয়া, সাম্প্রদায়িক দল সৃষ্টি করা, নতুন নামে মুসলিম লীগের ভাবাদর্শে রাজনৈতিক দল এবং প্রচার-প্রচারণাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজের তলদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে কঠিন করে দেয়া হয়েছিল।


এরপরও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পুনর্জীবন ঘটেছে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।

দল হিসেবে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়ে উঠলেও দলের ভেতরে আদর্শবাদী, ত্যাগী এবং শিক্ষিত মেধাবী নেতা-কর্মীর অভাব অনস্বীকার্য। 

আওয়ামী লীগের বিকল্প এখনও পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারকবাহক কোনো দল হতে পারেনি। যতদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিপূর্ণভাবে সে রকম একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সফল না হচ্ছে, ততদিন এই দলের ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখার আবশ্যকতা শেষ হবার নয়। সে জন্য দলের তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত দলকে এর ইতিহাস, ঐতিহ্য, আদর্শ এবং সৃজনশীলতাকে ধারণ করতেই হবে।


২০২৪ এ আওয়ামিলীগ এর পতন এর জন্য আওয়ামিলীগ ই দায়ী?

ইতিহাস সাক্ষী, যখন কোনো দল একইসঙ্গে বিরোধী ও ক্ষমতাসীন পক্ষে থাকে এবং সেটা যদি দীর্ঘদিন ধরে চলে, তখন দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত দৃশ্যের অবতারণা হয়। জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে শুরু হওয়া আওয়ামী লীগ এখন একক কণ্ঠের দলে পরিণত হয়েছে। যত বেশি সময় দলটি ক্ষমতায় থেকেছে, ততই এর কার্যক্রম কেন্দ্রীভূত হয়েছে। অতি ক্ষুদ্র থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণেও আর দলটির ভেতরে কোনো বিতর্ক হয় না; কেবলমাত্র শীর্ষ নেতার সিদ্ধান্তেই সব কাজ সম্পাদন হয়। স্থানীয় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতা বেছে নেওয়া, প্রতিটি পর্যায়ের নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া—সবকিছুতেই নেতার ইচ্ছাই সব।


বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ। যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে, নেতৃত্ব কাঠামোর প্রতিটি স্তরে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার উত্থান। দলটির তৃণমূল পর্যায়েও একই ধারা দেখা যায়। কারণ, দলের কোনো পর্যায়ে কোনো ধরনের জবাবদিহি নেই, নেতাকর্মীদের দলের প্রতি দায়িত্ব নেই; তারা কেবল শীর্ষপর্যায় থেকে আসা আদেশগুলোই পালন করে।

অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতা আদর্শিক কর্মী তৈরি না করে ক্ষমতার সুবিধাভোগী মানুষ নিয়ে দল ভারী করার ফল হলো ২৪ এ এই আওয়ামিলীগ এর পতন।দেশী বিদেশি ষড়যন্ত্র কিছুই সফল হত না যদি না উপরের বলা সমস্যাগুলোর ব্যাপারে আওয়ামিলীগ মনোযোগী হত।

আমি আশাবাদী আবারও আওয়ামিলীগ অতীতের ভুল শুধরে স্বমহিমায় এদেশের জনগণের আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে উঠবে।


অমিত রসুল অপি(এল.এল.বি)





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ

আমতলী উপজেলা আওয়ামিলীগ এর সভাপতি জি এম দেলোয়ার হোসেন এর ইন্তেকাল এ প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দদের শোক প্রকাশ